ক্রিকেটের প্রথম আন্তর্জাতিক মেগাস্টার ব্রায়ান লারার অবিশ্বাস্য গল্প

Brian Lara 

অনেকের মতে ক্রিকেটবিশ্বে এখন পর্যন্ত ব্রায়ান লারার মতো নিখুঁত ব্যাটসম্যান আসেননি আর একজনও। ক্রিকেট বল পেটানোটাকে রীতিমতো দৃষ্টিনন্দন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন এই ক্যারিবীয় বাটসম্যান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ও টেস্টে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি এখনো তার দখলে। টেস্টে ৯টি ডাবল সেঞ্চুরি ও ২টি ট্রিপল সেঞ্চুরি করা এখন পর্যন্ত একমাত্র ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা!
তাকে বলা হয় ‘ক্রিকেটের বরপুত্র’, কিন্তু এই ক্রিকেট বরপুত্র তার ক্যারিয়ারের শুরুতে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি।
ক্যারিবীয় ঘরোয়া ক্রিকেটে খৈ ফোটানোর মতো রানের ফুলঝুরি ছোটানোর মাধ্যমে সবার দৃষ্টি কেড়ে ১৯৯০ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলের হয়ে। অভিষেক টেস্ট সিরিজে পাকিস্তানের শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ততটা ভালো করতে পারেননি লারা। প্রথম ইনিংসে করেন ৪৪ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৫। সেই সিরিজেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতেও অভিষেক হয় লারার। ভালো করতে পারেননি অভিষেক ওয়ানডেতেও। মাত্র ১১ রান করেই ওয়াকার ইউনিসের বলে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় শুরুর কয়েকটা বছর সেভাবে সাফল্য পাননি তিনি। লারা নিজেকে পুরোপুরিভাবে মেলে ধরেন ১৯৯২-৯৩ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে। আর এরপর থেকেই তার জয়যাত্রার শুরু। সেই অসাধারণ আশ্চর্যজনক সাফল্যমণ্ডিত যাত্রার সমাপ্তি ঘটে ২০০৭ সালের ২১শে এপ্রিল।

ব্রায়ান লারার Shot

১৯৯৪ সালের গ্রীষ্ম মওসুমে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে ব্রায়ান লারার অনবদ্য ইনিংসগুলো তাকে ঐ বছরের ‘উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ মনোনীত করে দেয় অনায়াসে।
ওই বছরের এপ্রিল এবং জুনের মাঝামাঝি সময়ে লারার অতুলনীয় রেকর্ডের ফুলঝুরি কাউন্টি ক্রিকেটের সীমিত গণ্ডি ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বের নজর কেড়েছিল। এটি তার জন্মভূমি ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে সীমাহীন জাতীয় মর্যাদাবোধের কারণ হয়ে ওঠে; ফলশ্রুতিতে তিনি প্রচুর সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর এ অর্জনে দেশবাসীর মধ্যে দৃশ্যমান আনন্দ থাকলেও অনেকেরই কাছে এটি কোনো বড় বিস্ময় ছিল না। তাদের কেবলই মনে হয়েছে লারার অনিবার্য আবির্ভাব অনুমিত সময়ের অনেক আগেই চলে এসেছে।

ত্রিনিদাদের অধিবাসীরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যান্য অঞ্চলের বাইরে ত্রিনিদাদ থেকেই একজন মহানায়ক ব্যাটসম্যানের আগমন মনেপ্রাণে কামনা করতো, যা তারা কখনও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে দিতে পারে নি; আর লারার ব্যাটে অনেকদিন ধরেই সেই শূন্যস্থান পূরণের লক্ষণ প্রকাশিত হয়ে আসছিলো। ব্রায়ান লারার প্রায় যুগপৎ স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্সের টেস্টরেকর্ড এবং হানিফ মোহাম্মদের ফার্স্টক্লাস রেকর্ডগুলো ভেঙে দেওয়া সবচেয়ে আশাবাদী ব্যক্তিরাও কল্পনা করতে পারেন নি। কিন্তু যারা লারার প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেটের সূচনালগ্ন থেকে তার ওপর যারা নজর রাখছিলেন তারা এ ব্যাপারে নিঃসংশয় ছিলেন যে এই অর্জন তাঁর উচ্চাকাঙ্খা এবং সামর্থ্যের বাইরে ছিল না। বলাবলি হচ্ছিলো, যা পুরোপুরি ঐ মুহূর্তের উত্তেজনার ফলশ্রুতি ছিল না, লারা তাঁর ক্যারিয়ারজুড়ে নিজেকেই কেবল ছাড়িয়ে যেতে থাকবে।

Brian Lara HD Wallpapers 2

এই আত্মবিশ্বাসী মূল্যায়নগুলোর শক্ত ভিত্তি ছিল। পোর্ট অব স্পেনের ফাতিমা কলেজে জাতীয় আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতার এক মওসুমেই ৭ টি শতক হাঁকিয়েছিলেন ১৫ বছরের কিশোর লারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্ষিক অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। টানা চার বছর সেখানে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৫০-এর ওপর। তাঁর দ্বিতীয় ফার্স্টক্লাস ম্যাচে, তখন তা্র বয়স উনিশও হয় নি, তিনি ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্বাডোসের বিরুদ্ধে টানা পাঁচ ঘণ্টা ক্রিজে দাঁড়িয়ে ৯২ রান করেন, যে বার্বাডোস দলের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন জোয়েল গার্নার এবং ম্যালকম মার্শালের মতো কিংবদন্তিরা।

তারকাখ্যাতি লাভের আগেই লারা লারার গুণকীর্তনে কেবল ত্রিনিদাদের জনগণই অংশ নেন নি। অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৯৮৮ সালের যুব বিশ্বকাপে তাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের অধিনায়ক করা হয়। পরের বছর বয়স এবং অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বিদের বাদ দিয়ে লারাকে অধিনায়ক মনোনীত করা হয়। জিম্বাবুয়েগামী ওয়েস্ট ইন্ডিজ বি টিমের দেশে ফেরার পর তাকে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর ইতিহাসে কনিষ্ঠতম অধিনায়ক হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দলে স্থায়ীভাবে আসন পোক্ত করতে অনেক দেরি হয়েছিল তাঁর। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ভিভ রিচার্ডসের অনুপস্থিতির সুযোগে পাকিস্তানে তাঁর টেস্ট অভিষেক ঘটে। ১৯৯২ সালের এপ্রিলের আগে আর দলে ফুরতে পারেন নি। ততদিনে রিচার্ডস অবসরে চলে গেছেন। রিচার্ডসের শূন্যস্থান পূরণে তাঁর চেয়ে বেশি যোগ্য আর কেউ ছিলেন না। রেড স্ট্রাইপ কাপে ৫ ম্যাচে ৬২৭ রানের নতুন রেকর্ড (যদিও ক্ষণস্থায়ী) গড়ার পরও তাকে বসিয়ে রাখা হয়।

১৯৯১’র ইংল্যান্ড সফরের পর ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজ এবং জেফ্রি ডুজন একইসাথে অবসরে চলে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সুযোগ আসে এবং অনতিবিলম্বেই লারা ব্যাটিং লাইনআপের ভরকেন্দ্রে পরিণত হন, যাকে কেন্দ্র করে নবনির্মিত ব্যাটিং অর্ডার সাজানো হয়। ১৯৯২’র বিশ্বকাপে দলগতভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিটকে পড়লেও দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন লারা। ওপেনিং পজিশনে ব্যাট করতে নেমে ৮ ম্যাচে ৪৭.৫৭ গড়ে ৩৩৩ রান করে বিশ্বমঞ্চে নিজের আগমনী গান শুনিয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান এই ব্যাটিং গ্রেট। মোট রানের অর্ধেকই এসেছিলো বাউন্ডারি থেকে, যেখানে তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ৮১.৬১।

wp7200670 brian lara wallpapers 1

অন্য ক্রিকেটারদের মতো লারা সীমিত ওভারের খেলার কৃত্রিমতা দিয়ে নিজেকে মূল্যায়ন করতে পছন্দ করতেন না। ১৯৯৩’র জানুয়ারি মাসে সিডনিতে অনুষ্ঠিত ম্যাচে (তাঁর পঞ্চম টেস্টে) তার অনবদ্য ২৭৭ ত্রিনিদাদের ক্রিকেটপাগল মানুষের ধারণাকে সত্য প্রমাণ করেছিল যে, লারা সর্বকালের সেরা ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানদের তালিকায় নতুনতম সংযোজন। লারার একজন পূর্বসূরি যিনি বর্তমানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ম্যানেজার, তার ভাষায়- ‘এটি আমার দেখা সেরা ইনিংসগুলোর একটি।’ এই ইনিংসের তাৎক্ষণিক প্রভাব ক্যারিবিয়ানদের মনোবল এমনভাবে জাগিয়ে তুলেছিলো যে বিদেশের নাটিতে ঐ সময়ে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত সিরিজটি ২-১ ব্যবধানে জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর এর দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্য ছিল যে, এটা রিচার্ডসের অনুপস্থিতিতে লারাকে দলের প্রধান ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

এই ইনিংস লারার আত্মবিশ্বাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৯৩ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- ১৯৯৪ সালে তার লক্ষ্যমাত্রা কী হবে? উত্তর ছিল- ‘কয়েকটি সেঞ্চুরি, হয়তো বা একটি ডাবল সেঞ্চুরি, এমনি একটি ট্রিপল হান্ড্রেড।’ কিন্তু তিনি তার প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে যান।

পরেরবার রেড স্ট্রাইপ কাপে তিনি ৫ ম্যাচে ৭১৫ রানের নতুন রেকর্ড গড়েন। কিন্তু ৫ মাডের মাথায় এন্টিগুয়া টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক ইনিংসে ৩৭৫ রান এবং তার পরের ৮ ইনিংসে ৭ টি শতক আগের সব অর্জনকে ছাপিয়ে লারাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ঐ বছরের কাউন্টি ক্রিকেটে তাঁর শেষ ইনিংসটি ছিল ডারহামের বিপক্ষে অপরাজিত ৫০১!

১৯৯৫ সালে ইংল্যান্ড সফরে লারা টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে সিরিজসেরার পুরস্কার জিতে নেন। ঐ টেস্ট সিরিজটি ২-২ এ ড্র হয়েছিল। ১৯৯৮-৯৯ মওসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজের তৃতীয় টেস্টের শেষ ইনিংসে লারার অপরাজিত ১৫৩ রানে ভর ৩১১ রানের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এক উইকেট হাতে রেখে এই মহানায়কোচিত ইনিংসটিকে উইজডেন সর্বকালের সেরা টেস্ট ইনিংসের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে। পরের বছরগুলোতেও লারা তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ধরে রাখেন। ২০০৪ সালে লারার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে নেয়। এবছরই লারা টেস্টে ব্যক্তিগত ৪০০ রানের অমর এক মাইলফলক স্পর্শ করেন। সময়ের বিবর্তনে তাঁর এই কীর্তি কখনোই ম্লান হবে না। পরের বছর অ্যাডিলেড টেস্টে ব্রায়ান লারা এলান বোর্ডারকে টপকে টেস্টে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক বনে যান। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের পর লারা তাঁর বর্ণিল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি ঘটান। ক্যারিয়ারজুড়ে অসংখ্য পদক আর স্বীকৃতি অর্জন করের লারা যার শেষটা ছিল ২০১২ সালে ‘আইসিসি হল অব ফেমে’ তাঁর নামের অন্তর্ভুক্তিকরণ। বলা হয়ে থাকে, রেকর্ড গড়া হয় ভাঙারই জন্য। লারারও সব রেকর্ড হয়তো একদিন ভাঙবে অন্য কারও হাতে। তবে ক্রিকেটের ইতিহাসে চিরঅম্লান থেকে যাবেন ক্রিকেটের প্রথম আন্তর্জাতিক মেগাস্টার ‘দ্য প্রিন্স অব পোর্ট অব স্পেন’।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *