মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র একলব্য। আবার বলতে গেলে একলব্য মহাভারতের সবচেয়ে অবহেলিত চরিত্রগুলোর একটি। যে নিজ গুণে, নিজ চেষ্টায় হয়ে উঠেছিল অর্জুনের সমপর্যায়ের ধনুর্ধর, অনেক ক্ষেত্রে সে অর্জুনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
একলব্য ছিল নিষাদ রাজ্যের রাজপুত্র। অনার্য হিসেবে নিষাদরা সবসময়ই ছিল অবহেলিত। তাদের অবয়ব, বেটে আকৃতি, কুচকুচে কালো গাত্রবর্ণ, যুদ্ধ ক্ষেত্রে পারদর্শী না হওয়া তাদেরকে আর্যদের চোখে করে তুলেছিল হীন। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেই একলব্য স্বপ্ন দেখেছিল বিশ্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হওয়ার। সে পণ করেছিল যে কোন মূল্যে সে গুরু দ্রোণ এর শিষ্য হবে।
দ্রোণাচার্য ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অস্ত্রবিশারদ ও ধনুর্ধর। তিনি ছিলেন পান্ডব ও কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষার গুরু এবং যুদ্ধ শিক্ষার সমস্ত জ্ঞান তিনি তাদের প্রদান করেছিলেন। সেসময় ভারতবর্ষে দ্রোণাচার্যের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্রগুরু ছিল না। অর্জুন ছিল দ্রোণাচার্যের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। অর্জুনকে তিনি যে বিদ্যা দিয়েছেন অন্য কাউকে তিনি তা দেননি। পুত্র সমুতুল্য স্নেহ করতেন তিনি অর্জুনকে। তাই কেউ ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের সমকক্ষ হোক তা তিনি চাননি। অর্জুনের প্রতি দ্রোণাচার্যের এই বাৎসল্য একসময় একলব্যের জীবনে নিয়ে এসেছিল বিপর্যয়।
একলব্য যখন তার পিতাকে জানালো সে গুরু দ্রোণাচার্যের শিষ্য হতে চায় এবং সে উদ্দ্যেশ্যে ঘর থেকে বের হবে, তখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন পিতা হিরণ্যধনু। পিতা হিরণ্যধনু বুঝতে পেরেছিলেন আর্য নৃপতি লালিত ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য কখনোই একজন শূদ্র নিষাদপুত্রকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন না। কিন্তু একলব্য তার কথায় ছিল অনড়। এগিয়ে এলেন পিতামহ অনোমদর্শী। তিনি বললেন দ্রোণাচার্য উদার মানুষ, তার হৃদয় আকাশের মত বিশাল, একলব্যকে সে বুকে টেনেও নিতে পারে। আর একলব্য যদি আর্যদের তীর নিক্ষেপ জ্ঞান দখলে আনতে পারে তাহলে আর্যদের হারানো সহজ হবে। একলব্য এই বিদ্যা নিষাদদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবে, একটা সময়ে ব্যাধ সমাজে অসংখ্য ধনুর্বিদ তৈরি হবে, অস্ত্রবিদ্যায় আর্যদের সমকক্ষ হয়ে উঠবে নিষাদরা। এরপর আর রাজা হিরণ্যধনু পুত্রের কথায় আর আপত্তি করলেন না। হিরণ্যধনু ভাবলেন ছেলে যদি দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যার্জন সম্পন্ন করে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসতে পারে তাহলে নিষাদকুলে মস্ত বড় একটা ঘটনা হয়ে যাবে। এর আগে কোন নিষাদ আর্যগুরুর কাছে বিদ্যার্জন করার সৌভাগ্য লাভ করে নি, একলব্যই প্রথম সে সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। হিরণ্যধনু এও ভেবে হতাশ ছিলেন যদি দ্রোণাচার্য একলব্যকে ঘৃনায় ফিরিয়ে দেন তাহলে একলব্যের হৃদয় ভেঙে যাবে। এরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এর মধ্যেই তিনি পুত্রের যাত্রার আয়োজন করলেন।
এবড়ো-থেবড়ো, জঙ্গলাকীর্ণ ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একাই হস্তিনাপুরের রাজপথে যাত্রা শুরু করল একলব্য। কোন সৈন্য সামন্ত দরকার নেই তার। সৈন্যদলের আড়ম্বর তার কাছে অর্থহীন। সে যে দ্রোণাচার্যের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে, যেন সে তীর্থ দর্শনে যাচ্ছে। তার মনে একটাই আকুতি কখন সে দ্রোণাচার্যের শ্রীচরণে নিজেকে সমর্পণ করে পরম তৃপ্তি লাভ করবে, কবে আচার্যের শিষ্যত্ব প্রাপ্ত হয়ে নিজেকে ধন্য করবে। তার জীবনের মহার্ঘ হল আচার্য দ্রোণের শিষ্যত্ব লাভ।
দীর্ঘদিনের যাত্রায় ক্লান্ত শ্রান্ত, ক্ষুধার্ত একলব্য যখন গুরু দ্রোণের আশ্রমে পৌছালো তখন গুরু দ্রোণ কৌরব ও পান্ডবদের শিক্ষাদানে ব্যস্ত। একলব্য গুরুকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল সে গুরু দ্রোণের শিষ্য হতে চায়, তার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন সে দ্রোণাচার্যের শিষ্য হয়ে অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হবে। বিস্মিত হয়ে তাকালেন দ্রোণাচার্য, তার চোখেমুখে তাচ্ছিল্য আর উপস্থিত শিষ্য দের মধ্যে তৈরি হল একলব্যের প্রতি উপহাস। দ্রোণাচার্যের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ টগবগিয়ে উঠল। তিনি ভাবলেন একলব্য একেবারেই পৃথক এক জনগোষ্ঠীর মানুষ, তার আচার ব্যাবহার অবয়ব সবই আর্যদের থেকে আলাদা, তাকে কৌরব পান্ডবদের সাথে বসিয়ে শিক্ষাদান করা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। ক্ষুব্ধ গলায় তিনি একলব্যকে জানিয়ে দিলেন নিচু জাতের হীন বংশের কাওকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারবেন না। বহু বাসনার চির আকাঙ্খিত গুরু দ্রোণাচার্যের মুখে এ কথা শুনে নিষাদপুত্র একলব্য স্তম্ভিত হয়ে গেল। প্রাপ্তির আকাঙ্খায় যে অরন্য ভেদ করে একলব্য এসেছিল, অপ্রাপ্তির বুক ভরা কষ্ট নিয়েই সে অরণ্যের দিকে পা বাড়াল একলব্য।
গহীন অরণ্যে শুরু হল একলব্যের একনিষ্ঠ সাধনা, গুরু দ্রোণের মূর্তি তৈরি করে মনে মনে তাকেই গুরু মেনে নিজেই নিজেকে দীক্ষিত করে তুলতে লাগল একলব্য। নিজে নিজে সে এমন সব বাণ আবিষ্কার করল যা সে ছাড়া আর কেও জানে না। দ্রোণাচার্যের প্রতি নিষ্ঠা আর শ্রদ্ধার গুণেই সে এসব অস্ত্রের সন্ধান করতে শিখে গেল।
একদিন বনে ঘুরতে এসে গুরু দ্রোণ আর অর্জুন মুখোমুখি হল একলব্যের, একলব্য তখন দ্রোণের সব শিষ্য দের থেকেও বড় যোদ্ধা। একলব্যের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে দ্রোনাচার্য জানতে চান কে তার গুরু। একলব্য দ্রোণাচার্য কে গুরু বলে পরিচয় দেয়। সে দ্রোণাচার্যকে তার মুর্তি দেখিয়ে বলল গুরুদেব আমি এই মুর্তির ভিতর আপনাকে প্রতিষ্ঠা করেছি আর আপনাকেই গুরু মেনে সাধনা করেছি। আজকে আমার যে অর্জন তা সব আপনার জন্যই, আপনিই আমার গুরু। তখন সংশয়ে ভরে উঠে অর্জুনের মন, কারণ অর্জুন এর থেকে বেশি পারদর্শি ধনুর্ধর যে আর কেউ নেই, আর সেই যে গুরু দ্রোণ এর একমাত্র শিষ্য যাকে গুরু দ্রোণ সব বিদ্যাই দিয়েছেন। তাহলে একলব্য এত বিদ্যা কিভাবে শিখল, তবে কি গুরুদেব গোপনে একলব্যকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অর্জুনের মনের সংশয় দুর করতে দ্রোণাচার্য কূটবুদ্ধির আশ্রয় নিলেন। যে কিনা কখনো একলব্যকে হাতে কলমে শিক্ষা দেননি, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দুর দুর তাড়িয়ে দিয়েছেন, গুরু না হয়েও দ্রোণাচার্য একলব্যের কাছে গুরদক্ষিনা চেয়ে বসলেন।
এতদিন যে শিক্ষক কে দেবতুল্য সম্মান দিয়েছেন, আজ তার শিষ্যত্ব পাবে ভেবে একলব্য সরল মনে দ্রোণের যে কোন চাওয়া পূরণের প্রতিজ্ঞা করে বসে। দ্রোণ এটাই আশা করেছিলেন, তিনি গুরুদক্ষিণা হিসেবে একলব্যের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল চেয়ে বসলেন। অথচ উনি ভালমতোই জানতেন তীর চালানোর জন্য সবচেয়ে বেসি প্রয়োজনীয় অঙ্গ হচ্ছে বৃদ্ধাআঙ্গুল, একজন তীরন্দাজের বুড়ো আঙ্গুল কেটে নেওয়ার অর্থ আক্ষরিক ভাবে তাকে হত্যা করার সমতূল্য।
প্রতিজ্ঞ্যাবদ্ধ একলব্য গুরু দ্রোণের ধুর্তামি শেষ মুহুর্তে বুঝতে পারলেও তার কথা রাখেন। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নিজহাতে কেটে সে তা গুরুদক্ষিণা হিসেবে দান করে। কিন্তু গুরু দ্রোণ এর মধ্যে একলব্যের প্রতি কোন মায়া, ভালবাসার চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না। দ্রোণাচার্য এবার মনের শান্তিতে শিষ্যদের নিয়ে ফিরে গেলেন।
এত কিছুর পরেও একলব্য থেমে যায়নি, বার বার বাঁধা পাওয়ায় একলব্যের জেদ চেপে বসে। চার আঙ্গুলি দিয়েই আবার কঠোর সাধনা শুরু করে একলব্য। দিনের পর দিন কঠিন চর্চা করে সে নিজেকে আবার ও ছাড়িয়ে যায়। নিজের সাধনা পরিপুর্ণ হলে সে রাজ্যে ফিরে আসে।।
এইভাবেই একলব্য প্রমাণ করেছিল একলব্যরা কখনো হারিয়ে যায় না। তারা দমে যাবার পাত্র নয়। যত বাঁধাই আসুক তা যেন লক্ষ্য অর্জনের স্পৃহা কে আরো বাড়িয়ে দেয়। আর গুরুর প্রতি শিষ্যের একনিষ্ঠ ভক্তির উদাহরণ এই একলব্য। যে শুধু লড়াই করে গেছে শুধুমাত্র জাতিবিদ্বেষ এর বেড়াজাল ভেঙ্গে নিজের যোগ্যতার যাথার্থ সম্মান পেতে।