হুমায়ূন আহমেদ নামের এক জাদুকরের আগমন ঘটেছিল আমাদের দেশে। এই জাদুকর ১৩ই নভেম্বর ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একই সাথে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, গীতিকার, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার।পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত থেকেও পরবর্তীতে শুধুমাত্র লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থেই অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। তাঁর জীবন ছিল বর্ণাঢ্য , রঙিন ও সাফল্যমন্ডিত।
হুমায়ূন আহমেদের প্রতি অভিযোগ, তিনি প্রতিভাবান এবং তিনি তার সেই তথাকথিত প্রতিভার সঠিক ব্যবহার করতে পারেননি!
প্রশ্ন করা যায়,
প্রতিভার ব্যবহার তিনি করেননি কোথায়?!
অন্য অভিযোগ,
তিনি সাহিত্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু রেখে যেতে পারেননি!
সত্যিই কি তাই!
তাহলে উল্লেখযোগ্য কিছু বলতে কি বোঝানো হয়!?
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য বলতে আমরা সাধারণত যেসব বইয়ের কথা চট করে বলে ফেলি সেগুলোর একটাও কি গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে লেখা?
GoodReads এর টপ টেন ঘুরে আসুন দেখবেন সবগুলোই ১৯৫০ এর আগে প্রকাশিত। তারমানে এর পর থেকে লেখকরা আর গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখতে পারেননি!
এখনকার সাহিত্যের বিচার যদি তখনকার মাপকাঠি দিয়ে করা হয় তাহলে সেই বিচারের বিরুদ্ধে কিছু বলার অবকাশ আছে।
হুমায়ূনের সমালোচনা করার সময় যেই কথাটি সবচেয়ে বেশি আওড়ানো হয় তা হলো উনার বই সাহিত্যমূল্য বিচারে তেমন উচ্চমার্গীয় না। তথাকথিত ক্রিটিকসদের মতে হুমায়ূনের সাহিত্যকর্ম শুধুই বিনোদনের খোরাক।
আচ্ছা, একটা বই থেকে পাঠকের কী পাওয়ার আছে?
নিশ্চয়ই এমন কিছু, যা সে পড়তে পারবে এবং বুঝতেও পারবে।
এখন যদি এইযুগের সাধারণ পাঠকদের হাতে সেই সাহিত্যমর্যাদা প্রাপ্ত সুউচ্চমানের বইগুলা ধরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কী হবে?
আশা করি, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই না বুঝে বইটা ফেরত দেবে কিংবা কেউ কেউ বেশি উৎসাহী হয়ে বিক্রি করে কটকটিও খেয়ে ফেলতে পারে।
এইখানে আবার যুক্তি আসবে, “লেখকের কাজ নয় পাঠক যা চায় তা দেওয়া, লেখকের কাজ পাঠকের যা প্রয়োজন তা দেওয়া!”
এখন আপনার সেই প্রয়োজনীয় লেখাটি যদি আমি পড়তেই না পারি তাহলে আপনারও পেট খালি আর আমারও মাথা খালি।
হুমায়ূন এদেশের তরুণসমাজের হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে তাদেরকে বিমুগ্ধ করে টেবিল-চেয়ারে আটকে রেখেছিলেন যা বিশ্বসাহিত্যেও খুব কম লেখকই পেরেছিলেন।
আগেকার লেখাগুলো এখন বেশিরভাগ সাধারণ পাঠক বুঝতেই পারবে না তাই বোধহয় আমাদের তথাকথিত সাহিত্যবিশারদরা সেই অবোধ্য লেখাগুলোকে নিয়েই হুমায়ূনের সৃষ্টিকে হেয় করেন বা করার চেষ্টা করেন।
কোনো কোনো সমালোচক বলেন, হুমায়ূনের লেখায় সাহিত্যিক গভীরতা নেই।
গভীরতা আসলে কী?
গভীরতা মানে কি কঠিন কঠিন কিছু কথা বলা? কঠিন করে বলা?
যদি তাই হয় তাহলে গভীরতায় হারিয়ে না যাওয়ার জন্য হুমায়ুনকে ধন্যবাদ।
হুমায়ূন আমাদের এই যুগের লেখক, তার কাছ থেকে যদি Pride and Prejudice কিংবা War and Peace এর মতো লেখা আপনি আশা করেন তাহলে আপনার এবং আপনার সাহিত্যজ্ঞানের প্রতি সমবেদনা।
লেখকের যদি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতাই না থাকে তাহলে সেই মহান লেখাগুলো পড়বেটা কে!
আচ্ছা একজন লেখকের অনেক শতাব্দী বেঁচে থাকার জন্য কয়টি লেখা প্রয়োজন?
আমার তো মনে হয় হুমায়ূনের বেঁচে থাকার মতো সৃষ্টি হয়ে গেছে। বাকীসব বাদ দিলেও তিনি শুধু জোছনা ও জননীর গল্প দিয়েই বেঁচে থাকতে পারেন।
কী নিয়ে লেখেননি তিনি?
প্রেম, ফিলোসফি,সামাজিক দোষ-ত্রুটি-জটিলতা, সায়েন্স ফিকশন, মুক্তিযুদ্ধ,সাইকোলজি, কৌতুক, কবিতা, গান, নাটক, সিনেমা, আরো কত কিছু!
মিসির আলী এপার বাংলার প্রথম সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার চরিত্র,
হিমু বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র,
আরো আছে বাকের ভাই এর মতো ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক অবয়ব।
বাংলা নাটকে তার মতো শক্তিমান নাটক নির্মাতা খুব বেশি ছিলেন না।
এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই সব প্রায় সবই মানুষকে শিখিয়েছিল কিভাবে একটা সামান্য নাটকের সাথে নিজের জীবনকে মিশিয়ে ফেলতে হয়!
তাঁর সৃষ্ট উপন্যাসগুলো সবকিছুর মধ্যে উজ্জ্বল। মাত্র সত্তর-আশি পাতার ছোট্ট একটা বই দিয়ে মানুষকে বিভিন্নভাবে অভিভূত করার যে ক্ষমতা তাঁর ছিল, তা আদতেই আশ্চর্যজনক। সামান্য বর্ণনায় চরিত্রের গভীরতা আর দৃশ্যকল্প সৃষ্টিতে তাঁর পারদর্শিতা ছিল অনন্য।
আর তার সবচাইতে বড় সাফল্য তিনি চরিত্রায়নে, সম্ভবত বৈশ্বিক ভাবেই সেরাদের কাতারে পড়ার যোগ্যতা রাখেন।
আগুনের পরশমণি, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, মধ্যাহ্ন, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, কবিসহ আরো অনেক লেখা আছে যেগুলো একটু ভালো প্রমোশন পেলে বিশ্বসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো।
লেখক হিসেবে তিনি একই সঙ্গে সহজাত, সহজবোধ্য ও শক্তিশালী ছিলেন। এই সব অতিমানবিক গুণের ফলে সমাজের সব স্তরের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পেরেছিল তাঁর গল্প-উপন্যাস।
এই অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে যান ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই।
পরিশেষে একটা সামান্য উপলব্ধি তুলে ধরা যায়,
বেশিরভাগ উচ্চমানের লেখকেরই লেখা গুলো একটা সময় কংকাল হয়ে ঝুলে থাকে, সাধারণ পাঠকরা সেই বইগুলোর শুধু নামটাই মনে রাখে (BCS যারা দিতে চায় তারা সালসহ মনে রাখে)।
আশা করি এবং বিশ্বাসও করি হুমায়ূন অন্তত সেই সব লেখকদের কাতারে পড়ে যাবেন না।