কৈফিয়ত (ছোটগল্প)

pexels-steve-johnson-

“আমার ছেলেরে ট্রাক ডাইবার বানায়াম। ইনশাল্লা।”

সড়সড় শব্দে আধাময়লা কাপগুলোতে চা ঢালতে ঢালতে বললেন মামুন ভাই। মামুন ভাই আমাদের গ্রামের চা-দোকানদার। ছোটবেলায় যখন বেশ ঘনঘন বাড়ি আসা হতো, তখন থেকেই আমাদের দুই ভাইয়ের সাথে ওনার বেশ খাতির। তার ছেলে এবার ক্লাস থ্রিতে উঠল। পড়াশুনা জানা ছেলে ট্রাক ড্রাইভার কেন হবে জানতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি বললেন, “হারে ব্যাডা, তুই যে ভাস্সিটি পড়স, এরপরে কী করবি? পাঁচ বছর যাইব চারকি খুঁজতে খুঁজতেই। আমার পোলায় মেট্টিক পাশ দিলেই ডাইবারি লাইনে লাগায় দেয়াম। বিশ বছরের মইদ্যে ইনশাল্লা হের নিজেরই গাড়ি থাকব দুইডা।”

দাঁত দেখানো হাসি দিয়ে কাপ দু’টা তুলে নিলাম। একটা দিলাম পাশে বসা জামাল চাচাকে। সম্পর্কে চাচা হলেও বয়সে তিনি আমার প্রায় কাছাকাছিই। লেবু দেয়া রং চায়ের ধোঁয়া নাকে টেনে নিতে নিতে বললাম,

“তা অবশ্য খারাপ বলেন নাই ভাই। চাকরির বাজারের যে অবস্থা, পেট চালানোর যত সহজ রাস্তা ধরা যায় ততোই ভালো।”

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদী কণ্ঠে মামুন ভাই বলে উঠলেন,

“আয়ো না না, সোজা রাস্তায় শান্তি নাই। লাগলে কষ্ট করব, উপাস থাকব আমার পোলায়। তাও সব রাস্তায় যাওন যাইতে নাই।”

বলে দ্রুত এক পলক তাকালেন জামাল চাচার দিকে। ব্যাপারটা নজর এড়াল না আমার। সোজা রাস্তা বলতে মামুন ভাই চোরাচালান বুঝেছেন কিনা কে জানে! যদিও আমি সেরকম কিছুই বোঝাই নি।

বয়াম থেকে একটা ড্রাই কেক নিয়ে জামাল চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম,

“মোর্শেদ দাদারা কই? বাড়িঘরও কিচ্ছু নাই!”

জামাল চাচার মুখে তখন অনেকখানি চা। চা দিয়ে কুলকুচি করছিলেন। আমার কথার জবাব দেবার জন্য অল্প অল্প করে গিলতে শুরু করেছেন, আর তখনই ইমাম সাহেব এসে পড়লেন। আমাকে দেখেই উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,

“আরে ভাতিজা! কখন আসলা?”

ইমাম সাহেবের সাথে কথায় কথায় অনেক প্রসঙ্গেই আলাপ হলো। সময় পেরুলো বিস্তর। মাগরিবের সময় হয়ে যাওয়ায় উঠে পড়লাম আমরা দু’জন।

নামায, সন্ধ্যাকালীন দোয়াদরুদ শেষে উঠতে যাব, ইমাম সাহেব হাতের ইশারায় অপেক্ষা করতে বললেন। দুই রাকাত নফল পড়তে দাঁড়িয়ে গেলাম।

নামায শেষে ইমাম সাহেব নিয়ে এলেন মসজিদের পাশেই তাঁর ছোট্ট রুমে। বিছানায় পা তুলে বসে জিজ্ঞেস করলাম,

“আপনার মেয়েটার হাফেজি শেষ হইসে?”

“হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ। হইসে তো দুই বছর আগেই। এইবার ফাইভ পাশ করল। এ প্লাস পাইসে আল্লাহর রহমতে।”

“মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ।… আপনের মতোই ব্রেইনি হোক, আমিন।”

হেসে মৃদুস্বরে “আমিন” বললেন ইমাম সাহেব। হঠাৎ চট করে উঠে দাঁড়ালেন। যেন কিছু একটা মনে পড়েছে। টেবিলের ওপর থেকে তাঁর ট্যাব নিয়ে এসে ইউটিউবে গেলেন। বললেন,

“আরবী শিখানোর একটা চ্যানেল দেখাইতে নিয়া আসছি তুমারে। আমার দুইজন ছাত্র চালায় চ্যানেলটা। দাঁড়াও দেখাই।… ঐদিকে দেখ, ডিব্বাটায় বিস্কুট আছে। খাও।”

হাসতে হাসতে বললাম,

“আমার শরীরের সাইজ দেইখা মনে হয় এত ঘনঘন খাইতে পারি আমি?”

“এই বয়সে না খাইলে আর কহন?… এই, এই যে আসছে। সাবা সানাবিল ইনেস্টিটুট। দেখ ভিডিওগুলা। খুব সহজ কইরা শিখাইসে।”

ট্যাবটা হাতে নিতে নিতে বললাম,

“আরে চিনি তো ফাউন্ডেশনটা। ওরা তো চ্যারিটিয়ে না করে খালি জানতাম।”

কপাল কুঁচকে ইমাম সাহেব আমার দিকে তাকালেন,

“কী করে?”

“ঐ গরীবদের সাহায্য টাহায্য আরকি।”

“অহ। না, এখানে আরবী শিখায়। অনেক সহজ কইরা। দুই বছর আগে একবার বলসিলা শিখা শুরু করস। এখনও তো আরবীতে একটা মেসেজ দিতে পারলা না।”

হঠাৎ কথা থামিয়ে সচেতন হয়ে গেল ইমাম সাহেবের অভিব্যক্তি। ঝট করে জানালা খুলে দিলেন তিনি। টেবিল থেকে টর্চ নিয়ে জানালার বাইরে আলো ছুড়তেই নিচ থেকে একজনের গলা খাঁকারি শোনা গেল। সোজা নিচের দিকে লাইট ধরলেন ইমাম সাহেব।

“জামাল নি রে?”

সন্দেহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা ইমাম সাহেবের। জবাব আসলো,

“হ। লাইট বন্ধ করেন। শরম নাই?”

“আমার ঘরের পাশে মুতস, তোর আক্কল নাই? আমি নামায কালাম পড়ি।”

“নমাস তো পড়েন ঘরের ভিত্রে।”

বিরক্তি চেপে রেখে টর্চ বন্ধ করলেন ইমাম সাহেব। “তাত্তারি কাম সাইরা বাইত যা, যাহ।”

একটু পরেই টের পেলাম জামাল চাচা উঠে চলে যাচ্ছেন। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ইমাম সাহেব আমাকে নিয়ে জানালার কাছে গেলেন। টর্চ জ্বেলে তাক করলেন নিচের দিকে।

“দেখ তো ভাতিজা, পাতাগুলা ভিজা দেখা যায় নি?”

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম উজ্জ্বল সাদা টর্চের আলোর নিচে সব শুকনো। কপাল কুঁচকে তাকালাম ইমাম সাহেবের দিকে। চেয়ার টেনে বসলাম। তিনি জানালাটা খোলা রেখেই বসলেন খাটের ওপর, পা ঝুলিয়ে। চেয়ার ঘুরিয়ে মুখোমুখি হলাম। ইমাম সাহেব বলতে শুরু করলেন,

“শোনো ভাতিজা। শহরে বড় হইস তোমরা। গ্রামের অনেক কিছুই বুঝবা না। সকাল বেলা বাইর হও, গ্রামের এই মাথা থেইকা ঐ মাথায় যাও। যে-ই জানবে তুমি আমান ভাইয়ের ছেলে, নজির মাশটারের ভাতিজা, সেই দেখবা তোমারে খুব আদর যত্ন করবে। খোঁজখবর নিবে। আসলেও আশপাশের তিন চাইর গ্রামের মইধ্যে তোমাদের বাড়ির আলাদা একটা সম্মান আছে।”

“জ্বী, জানি এটা আলহামদুলিল্লাহ।”

“তোমাদের উত্তর বাড়িটারও নাম আছে। কিন্তু অন্য নাম। ডাকাত সন্ত্রাসী হিসাবে জানে সবাই তারারে। তারা তোমাদের আত্মীয় ক্যামনে, জানো?”

“দাদার ভাই…, মানে এরকম কী জানি।” অনিশ্চিত কণ্ঠে জবাব দিই আমি।

“না। তোমার দাদার বাপের চাস্তো ভাই ছিল ঐ বাড়ির মালেক কাকার বাবা।”

“আবার বলেন, কে-কী ছিল?”

“বাদ দাও। মানে মোটামুটি দূর সম্পর্কের আত্মীয় আরকি। মালেক কাকার ছেলে হইল এই জামাল। আর তোমার মোর্শেদ দাদায় হইল তোমার দাদার সৎ মায়ের ছেলে। সেই হিসাবে হেরা তোমাদের কাছাকাছি।”

ভুলে যাওয়া কথাটা যেন আবার মনে পড়ল। সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করলাম,

“মোর্শেদ দাদারা কই? জামাল কাকারে জিগাইসিলাম।”

শান্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন ইমাম সাহেব। উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভালো করে দেখলেন কেউ আছে কিনা। দরজার ওপাশটাও দেখে এলেন। আগের জায়গায় ফিরে, বসতে বসতে বললেন,

“মোর্শেদ কাকার বুঝ জ্ঞান কম। উল্টাপাল্টা ব্যবসা কইরা দুইন্যার লস খাইসে। জমি জিরাত বেচছে ইচ্ছামতো। বাঁইচা থাকতে তোমার দাদা, এরপর তোমার আব্বা, আমরা সবাই তারে অনেক বুঝাইসি। শুনে নাই। শেষে ধারদেনা শোধ করতে না পাইরা ভিটামাটি বেইচা দিসে মালেক কাকার কাছে। এই ধরো দুই সাপ্তা আগে। তোমার আব্বায় কয় নাই কিছু?”

“কী কন! না, আব্বার সাথে এইসব নিয়া তেমন আলাপ হয় না।… আর হুজুর, হেরা তো মানুষ ভালো না শুনসি। দামটাম দিসে ঠিকমতো?”

হতাশ চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকলেন ইমাম সাহেব।

“গ্রামের কিছুই বুঝ না বাবা তুমি। ভিটা বেইচা দেওয়া যে কি জিনিস তা তোমারে বুঝানো যাইব না।… যাক, ভিটামাটি বেইচা তোমার মোর্শেদ দাদা চইলা গেসে ইস্কুলের ঐদিকে, মাইজপাড়ায়।”

কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে পড়ছিল আমাদের বাড়ির সাথেই লাগোয়া ছিল মোর্শেদ দাদার বাড়ির ঘরগুলো। কত আসাযাওয়া ছিল আমার দাদা-দাদী বেঁচে থাকতে! তাঁরা মারা যাবার পর ছোট চাচা শহরে বাসা নিলেন। আমাদেরও বছরে দুই বছরে একবারের বেশি গ্রামে আসবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। তবে বাবার চাকুরির বয়স প্রায় শেষ। তাঁর ইচ্ছে শেষ বয়সটা আবার গ্রামেই কাটাবেন। গতবছর তাই বাবা আর চাচা মিলে আমাদের বাড়ির ঘরগুলো পাকা করেছেন। ছাদ দিয়েছেন। বিভিন্ন কারণে এতদিন আসতে পারি নি আমি। তবে ডিজাইন, বাড়ির ছবি দেখে বুঝেছি এ আমার পছন্দ হবে না। ছাদের ওপর একগাদা বইপত্র নিয়ে পড়ে থাকবার জন্য চিলেকোঠার মতো একটা ঘর বানাবার প্ল্যান নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। ইচ্ছে ছিল আমার সেই স্বপ্নের ঘরটা দেখে রাখবে মোর্শেদ দাদার ছোট ছেলে জসিম। সম্পর্কে চাচা হলেও, বয়সে আমার ভাতিজা হবে ছেলেটা।

আমাকে চুপ দেখে ইমাম সাহেব কথা বলে উঠলেন আবার,

“জামালে আমার দরজার নিচে লুকায়া আছিল, মোর্শেদ কাকারে নিয়া আমরা কিছু কই কিনা শুনতে। পস্রাব করার লাইগা কি তারার বাড়িতে লেট্টিন নাই নাকি? টাইলস লাগানো বাথরুম বানাইসে চোরাই হুন্ডা বেইচ্যা। আটটা হুন্ডা তো বেচছে দুই মাস আগেই। আমার জানালার তলে আইসে মুততে। কইলেই হইল!”

শঙ্কিত চোখে তাকালাম ইমাম সাহেবের দিকে।

“মালেক দাদা তো আব্বুকে খুব সম্মান করে। আব্বুর ইচ্ছা চাকরি শেষে গ্রামেই থাকবে। সমস্যা হবে না তো?”

ঠোঁট ওল্টালেন ইমাম সাহেব।

“বলতে পারলাম না ভাতিজা। মালেক কাকার মায়ে রাইত বারটা একটার সময় তোমাদের ঘরের চালার উপর ঢিল মারত। এটা আমিও জানতাম, তোমার চাচা-চাচীও জানতো। তবুও আমারে দুইবার ডাইকা নিয়া নজিরে ঘর বন্ধ করাইসে।… ভালো কথা, তোমার দেওয়া রুকইয়াহর বইটা পড়সি। অনেক উপকারী, মাশাল্লাহ।”

অনেক শঙ্কা, মন খারাপের মাঝেও একটু খুশি লাগল কথাটা শুনে। ইশার আযান শুরু হলো এরই মাঝে।

নামায শেষে আবার গিয়ে বসলাম মামুন ভাইয়ের দোকানে। কোণায় ছোট একটা টিভিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ইংল্যান্ড ক্রিকেট ম্যাচ দেখাচ্ছে। আমার পাশে বসে আছেন দেবু দা। সারাদিন অটোরিকশা চালিয়ে সবে ফিরলেন। এদিকে মামুন ভাইয়ের ছোট মেয়ে এক বাটি কাঁঠালের বিচি ভাজা দিয়ে গেছে দোকানে। আমরা তিনজনে খোসা ছাড়িয়ে খাচ্ছি। আচমকা দেবু দা “উঃ মাগ্গো” বলে বাঁ গাল চেপে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকালাম সেদিকে। রসিকতা করে জিজ্ঞেস করলাম,

“শক্ত বিচি কামড়ায়া দাঁত ভাইঙ্গা ফালাইসেন নি মিয়া?”

মামুন ভাই খ্যাকখ্যাক করে হাসতে হাসতে বললেন,

“দুরু না। কালকে মাইর খাইসে। থোতামোতা ভাইঙ্গা দিসে অক্করে দেবুর। দাঁতও লাড়ায়া লাইসে মনে হয়। ঐ দাঁতেই কামুড় পড়সে নি জিগা।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে অগ্নিচোখে মামুন ভাইয়ের দিকে তাকালেন দেবু দা। মামুন ভাই আরেকটা বিচি মুখে নিয়ে বললেন,

“চ্যাতস ক্যান? মালেক কাকা দামী জুতা পরে। হেই জুতার বাড়ি খাওনেও ইজ্জত আছে।”

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *