মাতা হারি (Mata Hari), যে নৃত্যশৈলীর জাদুময়তায় জয় করে নিয়েছিল আপামর দর্শক-শ্রোতার মন আবার বারবণিতা রূপে বশ করে নিয়েছিল সমাজের ক্ষমতাধর বিত্তশালীদের হৃদয়।
মাতা হারির আসল নাম মার্গারেটা গিরট্রুইডা (গ্রিইৎজা) জেলে। জন্ম ৭ আগষ্ট, ১৮৭৬ লিউয়ারডেন, নেদারল্যান্ডসে।
সিনেমার মতোই উত্থান-পতনে ভরা মাতা হারির বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্প। মাতা হারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন উচ্চবিত্ত পরিবারে। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। প্রচুর অর্থবিত্ত থাকায় মাতা হারি শৈশবে বেশ বিলাসী জীবন যাপন করেন। ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করেন একজন ডাচ সেনাবাহিনীর অফিসার, রুডলফ ম্যাকলেওডকে। দাম্পত্য জীবনে মাতা হারি সুখী ছিলেন না। রুডলফ ছিল তার চেয়েও ২০ বছরের বড়, মদ্যপ ও বিকৃত যৌনাচারী। হারী ও রুডলফ দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে ছিল।
স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর নিঃস্ব অবস্থায় প্যারিসে পৌঁছেছিলেন মাতা হারি । সেখানে এসে নিজেকে নতুন নামে নতুন রূপে পরিচিতি দিলেন মার্গারেট থেকে মাতা হারি নামে।
খুব দ্রুতই তিনি বিদেশি নর্তকী হিসেবে প্যারিসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। যৌনতা, নগ্নতা ও শরীর প্রদর্শনকে মাতা হারি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এভাবে শরীর প্রদর্শনের মাধ্যমে সুন্দরী, আকর্ষণীয়া হিসেবে তিনি খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
নাচের মঞ্চে সাহসী খোলামেলা উপস্থাপন ও শরীর প্রদর্শন ছিল দর্শক আকর্ষণ করার প্রধান হাতিয়ার। মাতা হারির নৃত্য উপস্থাপনার সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় অংশ ছিল নৃত্যরত অবস্থায় ক্রমে শরীরের সব বস্ত্র বিসর্জন দেওয়া। নাচের শেষে শুধু একটি বক্ষবন্ধনী, হাতে ও মাথায় কিছু অলংকার শোভা পেত। মাতা হারি সবসময় উচ্চভিলাসী ছিলেন। সবার সামনে নিজেকে সুন্দর, আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন, যখন যার সাথে কথা বলেছেন দেহভঙ্গি দিয়ে তার সবটুকু মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। সমাজের উচু স্তরের মানুষ, মন্ত্রী, জেনারেল, শিল্পপতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ সবার সাথেই উঠাবসা ছিল তার। মনোযোগ হরণ করেছেন অসংখ্য বিখ্যাত মানুষের। নিজের সুবিধার জন্য, নিজেকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের সাথে রাত কাটিয়েছেন। তার শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রেমিক ছিল অসংখ্য। তার নগ্ন নাচ দেখার জন্য, যৌন সম্পর্ক করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত সবাই।
এক সময় পত্রিকা গুলোতে শুধু মাতা হারিকে নিয়ে লেখালেখি হত। ১৯১৩ সালের মধ্যে অসংখ্য নৃত্যশিল্পী মাতা হারিকে অনুকরণ করা শুরু করে। মাতা হারি সমগ্র ইউরোপ জুড়ে অসংখ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। তবু কিছু কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সমালোচকদের মতে মাতা হারি নৃত্যে পারদর্শী ছিলেন না। কেবলমাত্র দেহ প্রদর্শনের মাধ্যমে তার সাফল্য এসেছে। সে সময়ের এক সংবাদপত্রে মাতা হারি কে নিয়ে লেখা,
“সারা শরীর জুড়ে বন্য পশুর ন্যায় ক্ষিপ্রতা, মাতা হারির দীঘল কালো কেশের তরঙ্গায়িত প্রবাহ সৃষ্টি হয় অপূর্ব এক ইন্দ্রজাল। নারীত্বের ভাস্বর প্রতীক সে। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে রচিত হয়েছে বেদনার গাঁথা, হাজারো কাব্যিক অঙ্গভঙ্গির সাথে নিখুঁত সমন্বয় ঘটেছে হাজারো মন মাতানো ছন্দের।”
এমনই সৌন্দর্যমন্ডিত দৈহিক অবয়ব ছিল মাতাহারির।
সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফরাসি দেশে চাপা আতঙ্ক বিরাজমান। এমন এক সময়ে মাতা হারি জাঁকজমকপূর্ণ জীবন সবার চোখে সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাতা হারির বিরুদ্ধে আনা হয় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ। যেহেতু মাতাহারির উঠা বসা ছিল অন্দরমহলের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে। ১৯১৭ সালের ১৩ ই ফেব্রুয়ারি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে নিজের হোটেল রুম থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ২৪ শে জুলাই তার বিচার কাজ শুরু হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল গোপন সংবাদপত্রের মাধ্যমে ৫০,০০০ ফরাসি সৈন্যকে হত্যার ঘটনায় জার্মানিকে সহায়তা করা। কিন্তু বিচারের সময় সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায় যে তিনি ছিলেন ডাবল এজেন্ট অর্থাৎ জার্মান ও মিত্রবাহিনী উভয়ের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন। যদিও মাতা হারি বরাবরই অস্বীকার করেছেন যে, তিনি গুপ্তচর নন । আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি বারবার বলেছেন,
“বারবণিতা? ঠিক আছে। গুপ্তচর? কখনোই না।”
কিন্তু আবহাওয়া তার প্রতিকূলে ছিলো। তিনি আশা করেছিলেন এতদিন যেসব ক্ষমতাশালী মানুষের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন তারা তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। কিন্তু একে একে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল সবাই। স্বামী-সন্তানদের সান্নিধ্য হারিয়েছিলেন অনেক আগেই। তিলে তিলে নিঃশেষিত সংকোচবোধ আর অনুকম্পার অভাবে নিঃস্ব অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। যদিও মাতা হারীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ ছিল নামমাত্র। শুধুমাত্র একটি টেলিগ্রামের বার্তার উপর ভিত্তি করে আদালত তাকে গুপ্তচর আখ্যায়িত করে।
যুদ্ধের সময় জার্মান সামরিক কর্মকর্তা আরনল্ড ভন কাল্লের পাঠানো একটি টেলিগ্রাম ফরাসী গোয়েন্দারা ধরে ফেলে, যাতে দেখা যায় ‘এজেন্ট এইচ টুয়েন্টিওয়ান’ বলে একজনের উল্লেখ আছে। এতে আরো ছিল মাতা হারির গৃহকর্মী মহিলার ঠিকানা ব্যাংকের তথ্য ইত্যাদি। ফলে গোয়েন্দাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এজেন্ট এইচ টুয়েন্টিওয়ান আসলে মাতা হারি-ই আর কেউ নয়। এছাড়া মাতা হারির স্বাক্ষ্য পড়ে যেটা বুঝা যায় নির্দোষ প্রমাণের চেয়ে আদালতে নিজেকে বড় করে দেখাতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সাপেক্ষে তথ্য না দিয়ে তিনি বারংবার ক্ষমতাশালী বন্ধু, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লোকজন আর নামিদামি থিয়েটারের কথা উল্লেখ করেছেন।
ফ্রান্সের সামরিক আদালত মাতা হারিকে অভিযুক্ত করে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।
১৫ অক্টোবর ১৯১৭ সালে ৪১ বছর বয়সী মাতা হারিকে সামরিক গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের উপকণ্ঠে শ্যাতো দু ভিসেনেস এ। তার সাথে ছিলেন দুজন নান আর তার আইনজীবী। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৈন্যরা। সেনাবাহিনীর পদাতিক ১২ জন সৈন্য কে নিয়ে গঠন করা হয়েছে ফায়ারিং স্কোয়াড। মাটির দেয়ালের সামনে একটি খুঁটি পুঁতে সেখানে দাঁড় করানো হলো মাতা হারি কে। তার পরনে ছিল লম্বা কোট আর মাথায় চওড়া টুপি। তার ইচ্ছে অনুযায়ী বাঁধা হলো না তার চোখ। ঘাতকদের মুখোমুখি অবিচল দাঁড়িয়ে রইলো সে। ভয়ের লেশমাত্র নেই তার চেহারায়। ওই চরম মুহূর্তে তিনি ফায়ারিং স্কোয়াডের সৈন্যদের দিকে উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দেন।
হটাৎ একসাথে গর্জে উঠল সবগুলো রাইফেল। হাত বাঁধা অবস্খাতেই হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলেন মাতা হারি। সোজা হয়ে রইল তার মাথা, খোলা রইল চোখ দুটো। সে দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল এক সৈনিক। পরে একজন সেনা অফিসার রিভলবার হাতে মাতা হারির দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তার মাথায় একটি গুলি করলেন। মাতাহারি অর্থ দিনের চোখ বা সূর্য। এক ভোরেই তার মৃত্যু হয়, ঠিক যখন সূর্য পূর্ব দিগন্তে উঁকি দিচ্ছিল।
উচ্চভিলাসী মাতা হারিকেও একসময় হতাশা আর দুর্দশা ঘিরে ধরেছিল। বুড়িয়ে যাওয়ার ভয়, কুৎসিত হয়ে যাওয়ার ভয় তার মধ্যে জেঁকে বসেছিল। শুধু ক্ষমতা আর বিত্তের লোভে নিজের দেহকে পুঁজি করে তিনি যে চূড়ায় উঠতে চেয়েছিলেন তা তাকে সম্মান দেয়নি, দেয়নি সমাজে কোনো গ্রহণযোগ্যতা। আর তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গুলো কতটুকু সত্য ছিল? নাকি শুধুমাত্র স্বাধীনচেতা, উচ্চভিলাসী হবার অপরাধে পুরুষতন্ত্রের ধূপকাষ্ঠে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছিল মাতা হারিকে।