মহাকালীন কথোপকথন (ভাবানুবাদ অকাব্য)

মহাকালীন কথোপকথন

মহাকালীন কথোপকথন

‘আপনি বাসায় ফেরার পথে মরে গেছেন!
এক্সিডেন্ট করেই মরেছেন ভেবে নিন,
আহামরি কোনো ঘটনা নয় এটি কিন্তু খুব মর্মান্তিক কিছুই ধরে নিন।
আপনার স্ত্রী-সন্তান আপনার পথ চেয়ে আছে,
বিভৎস পেইনলেস মৃত্যু পেয়েছেন আপনি।
ডাক্তারেরা চেষ্টার ত্রুটি করেনি যদিও,
তাও কোনো লাভ হয়নি।
আপনার বডি প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিল রাস্তায়,
বিশ্বাস করুন,
ঠিক তখনই আপনার সাথে আমার দেখা।’

‘মানে কি!
কীসব আবোলতাবোল কথা!’
আপনি জিজ্ঞেস করলেন
‘কোথায় আমি?’

‘আপনি মরে গেছেন জনাব’, আমি বললাম।
‘এখন আর স্বগোতক্তি করে লাভ নেই
একটা ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে
ঘটনাস্থলেই মরেছেন আপনি।’

‘কি!’

‘জ্বি’, আমি বললাম।

‘আমি…..আমি মরে গেছি!’

‘হ্যাঁ জনাব।
কিন্তু এটা নিয়ে এতোবার আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই,
একটা সময় সবাই মরে যায়’, আমি বললাম।

আপনি এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন
চারদিকে শুধুই শূন্যতার বিস্তার
শুধু আমি আর আপনি।

‘এটা আবার কেমন জায়গা?’
আপনি প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন,
‘তাহলে এটাই কি সেই পরকাল?’

‘হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে,
আমি নিজেও আসলে কনফিউজড’,
মাথা দুলিয়ে বললাম আমি।

‘আচ্ছা আপনিই কি গড?’
আবার প্রশ্ন আপনার।

‘হ্যাঁ’,
আমি শিরদাঁড়া করে খাড়া বলে দিলাম,
‘আমিই গড, প্রভু, স্রস্টা আরো যা যা বলেন সবই আমি’

‘কিছু জিনিস আছে যেগুলো আমাদের কল্পনায় থাকেনা সারাক্ষণ।
তারমধ্যে একটা হলো মৃত্যু,
এটা সবার সাথেই ঘটতে যাচ্ছে আমরা সবাই জানি।
অথচ আমরা এমন ভাবে বাঁচতে চাই যেনো মৃত্যু বলতে কিছুই নেই!
এমনকরে ভাবি যেনো আমরা কখনোই মরবোনা।
অন্তত এই মুহূর্তে তো মরবোই না।

প্রতিটি মুহুর্তে মৃত্যু থেকে দূরে সরে যাওয়ার আকাঙ্খা,
কিন্তু তাও মৃত্যু আমাদের পিছু ছাড়ে না কখনোই,
মৃত্যুতেই আচ্ছন্ন হয়ে থাকি নিজেদের আনমনে।

আমরা বইতে লিখি জীবন বড়ই ক্ষুদ্র সময়,
কিন্তু কখনোই আমরা সেটা বিশ্বাস করতে চাইনা।’,
আমি থেমে থেমে বলে চললাম।
‘আসলে কে আমরা?
মৃত্যু পর আমাদের আসলে কী হয়?
আপনার কী মনে হয়?’,
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে একটু জিরিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় প্রশ্নটা করা।

‘আমার স্ত্রী! আমার সন্তান!’
আপনি হটাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন।
‘কী হবে তাদের! তারা কি ভালো থাকবে?’

‘আমি তো চাই তারা ভালো থাকুক’, আমি বললাম।
‘এইযে আপনি এইমাত্র মারা গেলেন কিন্তু আপনার চিন্তা জুড়ে আপনার বউ-বাচ্চা,
এটা তো ভালো ব্যাপার।’

আপনি এবার অভিভূত হয়ে তাকালেন আমার দিকে,
আমি কোনো গডের মতো দেখতে নই
কোনো পুরুষ কিংবা নারীর মতোও নই,
না না, কিছুটা নারীসুলভ লাগছে হয়তো।
কিংবা অস্পষ্ট কোনো কর্তৃত্ববাদী অবতার,
আপনার চোখে আমাকে দেখে আসলে মনে হচ্ছে,
আমি কোনো গড নই বরং প্রাইমারি স্কুলের মাঝবয়েসী টিচার।

‘চিন্তার কিছু নেই’, আমি বললাম
‘তারা ভালো থাকবে,
আপনার সন্তানেরা আপনাকে ভালো মানুষ ভেবেই জীবন পার করবে।
তারা আপনার সাথে অতটা সময়ও কাটাতে পারেনি,
যাতে আপনাকে ঘৃণা করার মতো কিছু হয়ে যায়।
তার চেয়ে বরং আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বলা যাক,
সে লোকদেখানো কাঁদছে কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা প্রশান্তিও পাচ্ছে।
আপনার বিবাহিত জীবন অলরেডি ভেঙে পড়ছিল।
এখন আপনার স্ত্রী যে মনে মনে প্রশান্তি পাচ্ছে,
এটা নিয়ে তার আবার অপরাধবোধও হচ্ছে।’

‘ওহ!’ আপনি বললেন,
‘তো এখন আমার কী হবে?
আমি কি বেহেশতে যাচ্ছি নাকি নরকে?’

‘কোথাও না’, আমি বললাম
‘আপনি বরং আবার জন্ম নিন’

‘আহা, তারমানে হিন্দুরাই ঠিক ছিল!’,
আপনি উত্তেজিত হলেন।

‘সব ধর্মই তাদের নিজেদের হিসেবে সঠিক’, আমি বললাম।
‘আসুন আমার সাথে’
আপনি আমায় অনুসরণ করে হেঁটে চলেছেন,
চারিদিকে নিস্তব্ধ শূন্যতা।

‘এমন কোনো সময় ছিলনা যখন আমি কিংবা আপনি ছিলাম না,
আবার এমন কোনো সময় থাকবে না যখন আমি আপনি থাকবোনা।
এইভাবে চলতে থাকবে মহাকাল’, আমি বিস্তৃত তাকিয়ে বললাম।

‘তার মানে আমি যে জীবন যাপন করে এলাম সেটা আসলে কিছুই না
শুধুই কালক্ষেপণ!
আচ্ছা আমরা এখন যাচ্ছিটা কোথায়?’
আপনার কণ্ঠে জাগতিক বিরক্তি ঝরছে।

‘আসলে নির্দিষ্ট কোথাও যাচ্ছিনা আমরা,
আপনার সাথে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছি এটাই তো ভালো লাগছে।’

‘আচ্ছা বলুন, আমি যদি আবার জন্ম নিই
তাহলে আমার এই জন্মের কিছুই তো আমার মনে থাকবে না।
এই জীবনের এতোসব অর্জন আর অভিজ্ঞতা তার কিছুই আমার কোনো কাজে আসবে না!’

‘না না তা কেন হবে’, আমি আশ্বাসী স্বরে বললাম।
‘আপনার সব জ্ঞান অর্জন অভিজ্ঞতা সবই আপনার মধ্যেই থাকবে।
শুধু তৎক্ষনাৎ মনে পড়বে না আরকি।’

আমি হাঁটা থামালাম, মুখোমুখি হয়ে আপনার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
‘আপনার সত্ত্বা অনেক সুন্দর একটা এনটিটি,
এটা আপনার ভাবনার চেয়েও বৃহৎ
মানবিক মন নিয়ে এই প্রশস্ততা অনুধাবন করা যায়না।

ভেবে দেখুন আপনি এক গ্লাস পানিতে আঙুল লাগিয়েই
বলে দিতে পারেন এটা গরম নাকি ঠান্ডা
আপনি আপনার ক্ষুদ্র একটা অংশ ইনভেস্ট করে
ওই জিনিসটার সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা নিয়ে নিলেন৷

আপনি মাত্র ৪৯ বছর বেঁচে ছিলেন,
তারমানে জীবনের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আপনি মিস করে এলেন
তাও যা যা দেখে এসেছেন সেটাও নিতান্ত কম না।

যদি আমরা এখানে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটাই
তাহলে হয়তো আপনার সবই মনে পড়বে
কিন্তু সেটা করে আসলে কোনো লাভ নেই এখন’

‘তারমানে আপনি আমাকে আবার জীবন দিতে চান?’
আপনি কথার মোড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ অবশ্যই, কেন নয়?’ আমি বললাম।
‘আপনি হিন্দু ধর্মের নাম নিয়েছিলেন,
অথচ অন্য ধর্ম যেমন ইসলাম কিংবা খৃষ্টধর্ম নিয়ে বলি,
যদিও তারা পুনর্জন্মের ধারণা প্রিচ করেনা কিন্তু যদি তাদের স্ক্রিপচার দেখেন,
সেখানে বারবার বলা আছে জীবনকাল হলো একটা টেস্ট,
সত্যিকারের লাইফ তো আফটার লাইফে পাবেন,
যেখানে সত্যিকারের বেঁচে থাকা উপলব্ধি করবেন।
মৃত্যু আর মৃত্যুপর ধারণা কমবেশি সব ধর্মে একটু আলাদা হলেও,
সব ধর্মই তার অনুসারীদের উৎসাহের সহিত জানায় তাদের কৃতকর্মের ফল সম্পর্কে।
এই জীবনে আপনি কী করেছেন সেটা আপনার গন্তব্য নির্ধারণ করে দেবে।’

‘আসলে এইসবের মানেটা কি!’,
সিরিয়াস মুখ বানিয়ে বললেন আপনি।

‘আপনি কি আমাকে লাইফের মিনিং জিজ্ঞেস করলেন?
না মানে এটা কি একটু বেশি স্টেরিওটিপিক্যাল প্রশ্ন হয়ে গেলোনা?’,
আমার পাল্টা প্রশ্ন আপনাকে আরো বিরক্ত করলো।

আমি আপনার চোখের দিকে তাকালাম,
‘লাইফের মিনিং কিংবা অন্য কথায় এই ইউনিভার্স আমি বানিয়েছি আপনার জন্য,
যাতে আপনি পরিণত হতে পারেন, পূর্ণতা পেতে পারেন।’

‘তারমানে মানবজাতির পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য?’

‘না, শুধুই আপনার পূর্ণতার জন্য, আমি এই ইউনিভার্স বানিয়েছি শুধুই আপনার জন্য৷’

‘শুধু আমার জন্য! তাহলে অন্য সবাই কেন আছে? ওদের কী কাজ?’,
রিচার্ড ডকিন্স লেভেলের অবিশ্বাস ঝরছে আপনার কণ্ঠে।

‘আর কেউ কোথাও নেই’, আমি উত্তর দিলাম।
‘এই মহাবিশ্বে শুধুই আপনি আছেন’

‘কিন্তু ওই যে পৃথিবীতে এতোসব মানুষ!’ আপনি কিছুটা বিস্মিত।

‘হ্যাঁ সবই আপনি, সবকিছুই আপনার ইনকারনেশনস।’

‘ওয়েট, ওয়েট, তার মানে কি আমিই সবাই!’

‘এইতো বুঝতে পারছেন’, আপনার পিঠে নরম হাতের অভিবাদন দিয়ে বললাম।

‘তারমানে আমিই সবাই যারা বেঁচে আছে, বেঁচে ছিল, বেঁচে থাকবে?’

‘হ্যাঁ’, আমি বললাম মৃদু হেসে।

‘তারমানে আমি আব্রাহাম লিংকন?’, রসিকতার সুরে বললেন আপনি।

‘হ্যাঁ, আপনি আবার লিংকনের হন্তারক জন ওয়াইক্সও’, আমি যোগ করলাম।

‘আমি এডলফ হিটলার?’

‘হ্যাঁ, আবার আপনিই সেই ইহুদীরা যাদের সে মেরেছিল।’

‘আমিই তাহলে জিসাস?’

‘হ্যাঁ অবশ্যই, আবার আপনিই সবাই যারা তাকে ফলো করেছিল।’

আপনি এবার নিরব হলেন।

‘প্রত্যেকবার যখন আপনি কাউকে আক্রান্ত করেছেন’, আমি বলে যাচ্ছি।
‘আপনি নিজেকেই আসলে আক্রান্ত করেছেন।
যখনই কোনো দয়া দেখিয়েছেন কারো প্রতি, কারো মুখের হাসির কারণ হয়েছেন,
সেই দয়া সেই হাসি আপনার নিজেরই ছিল।
সকল মানুষের সুখ এবং দুঃখ আপনারই ছিল, আপনারই থাকবে।’

আপনি অনেকক্ষণ ধরে নিশ্চুপ আছেন।

‘কেন?’, আপনার প্রশ্নের শুরু হলো আবার
‘এতোসব কিছুর কারণটা আসলে কী?’

‘কারণ একসময় আপনি আমার মতো হবেন,
কারণ আপনি আমার মতোই একজন।
“আমি তো সব মানুষকে সৃষ্টি করেছি সু-গঠন ও অতি সুন্দরতম আকৃতিতে” শোনেননি?
আচ্ছা বুঝলাম কোরআন এর ধারে কাছে যাননি,
Genesis এ “God created man in His own image.” চোখে পড়েনি?
এর বেশি আর কি প্রয়োজন বলুন!’

‘তারমানে আমি গড!’, বিষ্ফোরিত চোখ আপনার।

‘না, এখনো না,
আপনি এখনো ভ্রুণের মতো,
যখন আপনার পূর্ণতা এসে যাবে, তখন আপনার জন্ম হবে পূর্ণ রূপে।’

‘তাহলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আসলেই একটা অণ্ড?’
আপনি এই প্রথম হেসে কিছু বললেন।

‘আপনি যা ভাবতে পছন্দ করেন সেটাই সত্যি’ আমি বললাম।

‘কিন্তু আমি কেন গড হবো?’

‘সে প্রশ্নের উত্তর আমি দিবোনা, আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিই না।
আপনি নিজেই বের করবেন একটা সময়।
একমাত্র আপনিই পারবেন সে উত্তর খুঁজে বের করতে।’


  • Abstract Translation of The Egg By Andy Weir

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *