ওপারের বাড়ি (ছোটগল্প)

brown-and-white-house

বড় ফুপু মাত্র বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ যাবত দরজা আবজে দিয়ে নিজের রুমে শুয়ে আছে রাফিদ। ওর খুব মন খারাপ।
.
ফুপাত বোনের স্বামী বিদেশে থাকেন। ফ্রান্সে। ফ্রান্স খুব খারাপ দেশ। আমাদের নবীজি ﷺকে নিয়ে বাজে কার্টুন আঁকে ওরা। কিন্তু ঐ দেশে যারা যায় তাদের অনেক টাকা হয়। তাদের ফ্যামিলিও খুব বড়লোক হয়ে যায়। তবু রাফিদ বা তার ভাই ঐ পচা দেশে যাবে না। ফুপাত বোনের স্বামী রাফিদদের কী যেন হয়? দুলাভাই, নাকি দেবর? ক্লাস সিক্সে পড়েও আত্মীয়তার সম্পর্কীয় নামগুলো রাফিদ মনে রাখতে পারে না। আচ্ছা, উনাকে যেহেতু রাফিদরা সাব্বির ভাই বলে ডাকে তাহলে দুলাভাই-ই হওয়ার কথা। দুই বছর আগে দুলাভাই যখন এসেছিল, তখন রাফিদ বলে দিয়েছে পরেরবার ওর জন্য একটা হাতঘড়ি আনতে। নাম্বার ওঠা ঘড়িগুলো না, কাঁটাওয়ালা ঘড়ি। রাফিদের বড় ভাই রাগীব বকা দিয়ে বলেছে, “গাধা, ঘড়ি ভালো পাওয়া যায় সুইৎজারল্যান্ডে। সাব্বির ভাইয়া, আমার জন্য বডি স্প্রে আইনেন।” সাব্বির ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন দুই ভাইয়ের আব্দার শুনে। দারুণ আগ্রহের সাথে বলেছিলেন অবশ্যই আনবেন। আর এমন সময়ই আম্মু পেছন থেকে দুই ভাইয়ের কান টেনে বলেছিল, “ছি ছি। দেখ তো কেমন ছোঁচা হয়ে গেছে ছেলে দু’টা! সাব্বির, কিচ্ছু আনা লাগবে না ওদের জন্য।”
.
“আম্মু নিজে তো জীবনে কিছু দেয় না আমাদের, অন্য কেউ দিতে চাইলেও সহ্য করে না। পৃথিবীর আর কোনো মা এমন, দেখাতে পারবি?” সেদিন রাতে দাঁত ব্রাশ ট্রাশ করে নিজের বিছানায় ঘুমুতে যাওয়ার আগে রাগীব ভাইয়া খুব আক্ষেপ করে রাফিদকে বলেছিল। ভাইয়া তখন ফাইভে পড়তো। অথচ কি বোকাই না ছিল! আম্মু কত কিছু করে ওদের জন্য! হিসেব করতে বসলে গুনে শেষ করা যাবে? আর রাফিদ তো শুনেছে সেদিন গভীর রাতে নামায শেষে আম্মু আল্লাহর কাছে কাঁদতে কাঁদতে কী বলেছে। সবগুলো কথা অবশ্য সে মনে করে করে বলতে পারবে না। তাহলে ওর কান্না চলে আসবে। অন্তত এটুকু বলা যায়, ওর মা আল্লাহকে বলেছে তাঁর ছেলেরা যেন অল্পে খুশি থাকে। যেন কক্ষনো কারো কাছে হাত পাততে না হয়। যা দরকার, যতটুকু লাগে সব যেন আল্লাহই দিয়ে দেন।
.
রাফিদরা গরীব। অন্তত ফুপুদের চাইতে তো গরীব। বড় ফুপুর দুই মেয়ের দুই জামাই দুই দেশে থাকে। বিদেশে। দু’টাই খ্রিষ্টান দেশ। ফুপুর ছেলেও থাকে বিদেশে। কাতার না কুয়েত যেন। এটা মুসলিম দেশ। ছোট ফুপুর এক মেয়ে। তার স্বামীও বড় চাকরি করে। বাবার মতো হেঁটে হেঁটে অফিসে যায় না। বাজারের ভারী ব্যাগ নিয়ে থপ থপ করে সিঁড়ি ভেঙে ওঠে না।
.
রাফিদ রুম থেকে বের হয়ে এলো। আম্মুও তখন রান্নাঘর থেকে তাঁদের রুমে যাচ্ছিল। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল আম্মু। কেন? আম্মুর কি মন খারাপ? খুব খারাপ? রাগীব ভাইয়ার রেজাল্ট দিয়েছে? ও কি পাঁচের ভেতরে নেই? নাকি রাফিদেরটা ওর ক্লাসটিচার ফোন করে আম্মুকে জানিয়েছেন? এবার রোল বিশের ভেতর আনতে পারলে বাবা একটা গিফট দেবে বলেছে। পরীক্ষা তো ভালোই দিয়েছিল রাফিদ। বিশের ভেতর না হোক, অন্তত বাইশ চব্বিশের মাঝে চলে আসার কথা। ভাবতে ভাবতে রাফিদ এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। আজকে আসরের সালাত আদায় হয় নি। খেলতে যাওয়াও হলো না। শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। জাগার পরও ঘুমের রেশটা ওর চোখেমুখে রয়ে গেছে। আগে থেকেই তো মন খারাপ ছিল, এখন দেখে মনে হচ্ছে সেটার মাত্রা আরও ভীষণ বেড়ে গেছে।
.
রাস্তার ডানপাশ ধরে বাবাকে আসতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিন বাবা দরজা খুলেই উঁচু গলায় সালাম দেয়। ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে। আজ রাফিদের সামনে সুযোগ আগে থেকেই দরজা খুলে রেখে বাবাকে দেখামাত্রই সালাম দেওয়ার। আগে সালাম দিলে বেশি সওয়াব। বাবার হাতে আজ বাজারের ব্যাগ থাকলে আরও সওয়াব হতো। বড়দের সাহায্য করলেও অনেক সওয়াব। বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে রাখার মাধ্যমে দু’জনকেই খুশি করার সুযোগটা মিস হয়ে গেল। বাজারগুলো গুছিয়ে রাখলে মা’র কাজেও কিছুটা সাহায্য করা যেত। সেটাও মিস। ধ্যাৎ। ভাবতে ভাবতে দরজা খুলল রাফিদ। বাবা আসছে। রাফিদ জানে, বাবা সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ উঠছে, আর মনে মনে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার বলছে।
.
বাবার পেছনে আসরের সালাত পড়ে রাফিদ বই পত্র গোছাতে লাগল। সন্ধ্যার পর আশিকদের বাসায় যেতে হবে। যদিও বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, নতুন ক্লাস শুরু হতে ঢের দেরী, তবুও টুকটাক কিছু জিনিস পড়ে নিচ্ছে রাফিদ আর ওর কয়েকজন বন্ধু। অবশ্য এই সময়টায়, মানে নতুন বছরের ক্লাস শুরু হবার আগের কিছুদিন পড়ার চেয়ে আড্ডাই বেশি হয়। সাজিদ ভাইয়া ওদেরকে পড়াতে আসেন। সাজিদ ইসলাম ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। কত কিছু জানেন উনি! মাশাআল্লাহ। আর লেখালেখি করেন। ব্লগে। ফেইসবুকে। কি যে চমৎকার তাঁর লেখার ভাষা! সব ইসলাম বিষয়ক। মাঝেমাঝে ওরা বুঝবে এমন কিছু লেখা পড়ে শোনান সাজিদ ভাইয়া। কখনো কখনো অন্যদের লেখাও পড়েন। আর সাজিদ ভাইয়ার মতো অঙ্ক বোঝানো? হুহ। কারো পক্ষেই সম্ভব না। কলম, কম্পাস, পেন্সিলগুলো রাখার জন্য বক্সটা খুলতেই ভেতরে দেখা গেল কয়েকটা চকলেট। বিদেশি। ছোট, বড়, গোল। লম্বা-চ্যাপ্টা। কোত্থেকে এল? ওহহো বড় ফুপু তো এসেছিলেন বাসায়। সাব্বির ভাই দেশে এসেছেন। এমন সময় শোনা গেল পাশের রুমে মা বাবা কথা বলছে।
“শাহানা আপা এসেছিল।”
“কে? বড় বুবু?”
“হ্যাঁ। চকলেট, সাবান টাবান দিল কতগুলো। বললাম আপনার ভাইয়ের সাথে দেখা করে যান। বসল না বেশিক্ষণ। আরও কয়েক জায়গায় যেতে হবে নাকি।”
“ও। আচ্ছা যাব একসময় ওদের বাড়িতে।” চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাবা বলল, “জামাইয়ের সাথেও দেখা হবে। আছে না কিছুদিন দেশে?”
“থাকবে তো বলল এক সপ্তাহের মতো আপাদের বাসায়। তুমি গেলে বাসায় আসতে বলো।”
“বলব বলব। ছেলেটা অমায়িক খুব। মাশাল্লাহ।”
“ছাই অমায়িক। রাফিদটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চুউপ করে তাকিয়ে ছিল আপা যখন জিনিস পত্র বের করছে। ছেলেটা না জানি কত আশায় আশায় ছিল তার জন্য ঘড়ি আনবে। বড়টা তো কোচিংয়ের পর এখনো আসে নাই। খেলতে গেছে মনে হয় সরাসরি। একটা সেন্ট খুঁজছিল। অনেক মন খারাপ করবে।”
“আরে না। আমার ছেলেদের চেনই না এখনও তুমি।” চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বাবা যোগ করল, “ওরা এইসব ছোটখাটো অপ্রাপ্তি পাত্তা দেয় না। ওদের মনে অনেক দূরের স্বপ্ন গেঁথে দিয়েছি না আমি?” একটু থেমে বাবা আবার বলল, “আর সাব্বির হয়তো ভুলে গিয়েছে ওদের দাবির কথা। কতজনের জন্য কতকিছু আনতে হয় না ওর?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলল, “যতই হোক, বাচ্চা মানুষ এখনও। একটু সাধ আহ্লাদ তো থাকেই। একটা মামা নাই, চাচা নাই ছেলেগুলার। আব্দার টাব্দার কার কাছেই বা করবে?” একটু থেমে মা আবার বলল, “নাহয় আমিও তো চাই ওদের দুনিয়াবি চাওয়াপাওয়া কম থাকুক। তবুও আসরের নামাযের জন্য ডাকতে গিয়ে দেখি ছোটটা ঘুমের মধ্যে কাঁদতেসে। দেখে এত মায়া লাগল! এজন্যই এতকিছু বলা এখন। আল্লাহ মাফ করুক আমাকে।”
বাবা তখন বড় একটা শ্বাস টেনে বলল, “খারাপ কি আমারও লাগে না? যখন দেখি ওদের বন্ধুদের বাবারা তাদের ছেলেদেরকে এখন তখন এটা ওটা কিনে দিচ্ছে, ওদের বন্ধুরা বাসায় এসে সেগুলো দেখাচ্ছে, আমারও তো মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় আমার ছেলেদেরও এই সুখ হোক। কিন্তু তখন কী মনে পড়ে জানো?”
“কী? জান্নাতের কথা?”
“সেটা তো আছেই। আরও একটা বাক্য মাথায় আসে। ‘টাকা না থাকলে যেটা হতো লাক্সারি, টাকা বেশী হলে ওটাই হবে ‘বেসিক নিড’!’ বুঝলে কিছু?”
“বুঝলাম। কথাটা তো সুন্দর! সুবহানআল্লাহ।”
.
ফিক করে হেসে দিল রাফিদ। অনেক আগে কথাটা বাবাকে ও-ই শিখিয়েছিল। ও শুনেছে সাজিদ ভাইয়ার কাছে। সাজিদ ভাইয়া সেদিন নিলয় নামের একজনের একটা লেখা পড়ে শুনিয়েছিলেন। লেখাটার শিরোনাম ছিল “আরাম”। ভাবতে ভাবতে মাগরিবের আযান দিতে শুরু করে। বাবা ঐ রুম থেকে ডাক দেয় রাফিদকে। চটপট নাস্তা সেরে সালাত পড়েই আশিকদের বাসায় যেতে হবে। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে টুপিটা মাথায় পরতে পরতে রাফিদ ভাবে জান্নাতের কথা। যেখানে গিয়ে চাইলেই সাইকেল পাওয়া যাবে, ঘড়ি পাওয়া যাবে, বডি স্প্রেও পাওয়া যাবে। আর থাকবে সুন্দর একটা বাড়ি। সাজিদ ভাইয়া প্রায়ই লেখেন, বলেন, “আকাশের ওপারে, জান্নাতের ঐ অনিন্দ্যসুন্দর বাজারে, যেখানে কোন দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, মন খারাপের কারণ নেই, যেখানে কেউ মিথ্যা কথা বলে না, যেখানে কোন খারাপ মানুষ নেই, সেখানে যেন আল্লাহ আমাদেরকে একত্রিত করেন। আমীন।”

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *